বিশেষ প্রতিনিধি, ক্যাম্পাস মিরর প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার , ১০ এপ্রিল , ২০২৫
বাটা কোম্পানির বর্তমান সদরদপ্তর। ছবি: সংগৃহীত
জুতা বলতে অনেকের প্রথম যে শব্দটি মনে আসে তা হল ‘বাটা’। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সি অনেক মানুষের প্রথম পছন্দ বাটার জুতা। জীবনে কোনোদিন বাটার জুতা ব্যবহার করেননি, বাংলাদেশে এমন মানুষের দেখা মেলা ভার।
সেই বাটা জুতাকেই বয়কটের ডাক আসে নানা সময়ে। কারণ হিসাবে বলা হয়ে থাকে, বাটা ইসরায়েলি পণ্য। ইসরাইলি কোম্পানি হিসাবে প্রচারের কারণে সরাসরি আক্রান্তও হয়েছে কোম্পানিটি।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলার বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভের মধ্যে সম্প্রতি তাদের কয়েকটি শোরুমে হামলা-লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু আসলেই বাটা কি ইসরাইলি কোম্পানি?
বাটা বাংলাদেশ বলেছে, ‘ভ্রান্ত ধারণার’ উপর ভিত্তি করে আক্রান্ত হয়েছেন তারা। বাটা একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যার যাত্রা শুরু হয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে এবং কোনো রাজনৈতিক সংঘর্ষের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
১৮৯৪ সালে ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে বাটা সু’র যাত্রা শুরু করেন চেক নাগরিক টমাস বাটা। তার মৃত্যুর পর ছেলের হাত ধরে বিকশিত হয় পারিবারিক এই ব্যবসা।
বছরে সবচেয়ে বেশি জুতার উৎপাদক ও বিক্রেতা হিসাবে ২০০৪ সালে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছিল বাটা। ১৩১ বছরের পুরনো এ কোম্পানি এখন প্রতিদিন ১০ লাখের বেশি মানুষের কাছে জুতা বিক্রি করে।
বর্তমানে বিশ্বের ৭০টি দেশে উপস্থিতি রয়েছে এ কোম্পানির। ২০ দেশে ২৭টি উৎপাদন কারখানা রয়েছে তাদের। অটোমেশনের এই সময়েও কোম্পানিতে কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার কর্মী।
আসুন, বাটার ইতিহাস এবং পথচলার গল্পে চোখ বুলিয়ে নিই—
বাটার শুরু এবং বেড়ে ওঠা
টমাস বাটা নিজের নামে ১৮৯৪ সালের ২৪ অগাস্ট তৎকালীন চেকস্লোভাকিয়ার(বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র) জ্লিন শহরে একটি জুতার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েক দশকের মধ্যে ইউরোপের শীর্ষ জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বাটা। যার মূলে ছিল কোম্পানির স্মার্ট উদ্ভাবন, যন্ত্রের সুষম ব্যবহার এবং সাশ্রয়ী দাম।
ভাইবোনদের সঙ্গে টমাস বাটা।
১৯৩২ সালের ১২ জুলাই নিজের ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্সের ঠিক বাইরেই বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান টমাস বাটা। তার ছেলে টমাস জুনিয়র কোম্পানিতে সিংহভাগ ব্যবসার উত্তরাধিকারী হন এবং প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাটা শু অর্গানাইজেশন’ নামক হোল্ডিং কোম্পানি।
চেকস্লোভাকিয়ায় সাফল্যের পথ ধরে ১৯৩৩ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসসহ আরও কয়েকটি দেশে কারখানা গড়ে তোলে বাটা। নেদারল্যান্ডসের বেস্ট এলাকায় নগর কর্তৃপক্ষ থেকে জায়গা কিনে নেয় বাটা এবং জ্লিনে অবস্থিত সদরদপ্তরের আদলে নির্মাণ করে ‘বাটা ভিলেজ’; ডাচ ভাষায় যেটার নাম ‘বাটাডর্প’।
শহর থেকে কিছুটা দূরে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি আছে এমন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল ‘বাটা ভিলেজ’। যেখানে বয়ে চলা চমৎকার খালের কাছাকাছি এসে মিলিত হয়েছিল রেল সংযোগও।
তবে কর্মীদের বসবাসের সুবিধার্থে এই বাটা ভিলেজ ছিল কারখানার কাছাকাছি। ১৩০টি বাড়ি নিয়ে গঠিত এলাকাটি; যার কাছেই রয়েছে নিজস্ব স্কুল, মেডিকেল সেন্টার, ফুটবল আর টেনিস ক্লাবসহ নানান সুবিধা।
সেতু না থাকায় ‘বাটা ভিলেজ’ শহর থেকে মোটামুটি আলাদা ছিল। এর ফলে নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে গড়ে ওঠে বাটা কমিউনিটি।
বাটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালসের সদরদপ্তর এবং নেদারল্যান্ডসের কারখানার পাশাপাশি এখনও সেই পুরোনো কিছু বাড়ি সেখানে রয়েছে। সমতল ছাদের কারণে সহজে চেনা যায় সেসব বাড়ি।
১৯৩৪ সালে এসে নারী, পুরুষ, শিশু এবং অ্যাথলেটিক জুতা বানানোর নতুন কারখানা নির্মাণ করে বাটা। কারখানার সঙ্গেই ছিল বয়লার রুম, ট্যানারি, প্রিন্টার এবং নির্মাতা কোম্পানি। ১৯৩৮ সালের মধ্যেই ৩০টির বেশি দেশে ব্যবসার নতুন দ্বার খুলে বাটা।
ষাটের দশকে এসে পশ্চিম ইউরোপে মানুষের আয়ে এক ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে, শ্রমঘন জুতা শিল্প নিম্মবেতনের দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হয়। সত্তরের দশকের শেষ দিকে এসে বিশেষ বিশেষ ধরনের পেশাদার জুতা উৎপাদনে মনোনিবেশ করে নেদারল্যান্ডসের বাটা কারখানা।
উৎপাদন কমে আসায় ওই সময়ে কারখানার পরিসর ছোট করে বাটা কোম্পানি। ১৯৭৮ সালে বেস্ট-এর নগর কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু জমিও বিক্রি করে দেয় বাটা। খালি করা হয় অনেক ভবন এবং বাটা ভিলেজের কিছু অংশ।
১৯৯৬ সালে এসে নেদারল্যান্ডসের বাটা কোম্পানি ফ্যাশন সু বানানো বাদ দিয়ে নিরাপত্তা পাদুকার দিকে ধাবিত হয়। এ সময়ে সেখানকার ফ্যাক্টরিতে তৈরি হতে থাকে উচ্চ মানসম্পন্ন জুতা এবং মোজা।
২০০৪ সালে যন্ত্রপাতি ও প্রডাকশন লাইনের অটোমেশন এবং রোবটাইজেশনে বিনিয়োগ করে বাটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালস।
২০০৬ সালে বাটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালস বিশ্বব্যাপী অন্যদের সঙ্গে পার্টনারশিপে চলে যায় এবং গঠন করা হয় বাটা ব্র্যান্ডের ব্যবসা শাখা।
বাটার প্রথম সদরদপ্তর ভবন। সে সময় ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উঁচু ভবন ছিল এটি।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৯৪তম জন্মদিনের ঠিক আগে কানাডার টরন্টোতে মারা যান প্রতিষ্ঠাতা টমাস বাটার ছেলে টমাস জুনিয়র। যার হাত ধরে সারাবিশ্বে বিস্তৃত হয়েছিল বাটা।
বাটার সদরদপ্তর কোথায়?
যেখানে বাটার শুরুটা হয়েছিল, চেকস্লোভাকিয়ার সেই জ্লিন (Zlin) শহরের সুরম্য অট্টালিকায় ছিল বাটার সদরদপ্তর। ১৯৩৮ সালে ১৬ তলা ভবনটি যখন নির্মাণ করা হয়, তখন এটি ছিল ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন।
‘বিল্ডিং নাম্বার ২১’ নামক এই ভবনে ছিল বাটা সু’র প্রশাসনিক কার্যালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক বোমাবর্ষণের মধ্যেও অক্ষত থেকে গেছে বাটা সু’র ভবনটি।
ভেঙ্গে যাওয়া ঠেকাতে ২০০৮ সালে বড় রকমের রেস্টোরেশন হয় ভবনটিতে। এখনও সেখানে বাটার কার্যালয় রয়েছে। তবে, এটা জ্লিন শহরের অন্যতম দর্শনীয় এলাকা।
১৯৬৪ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের জ্লিন থেকে বাটা করপোরেশনের সদরদপ্তর স্থানান্তরিত হয় কানাডার টরন্টোতে। তবে ভূমি নিয়ে আগা খান ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ২০০৩ সালের দিকে সদরদপ্তর আনা হয় সুইজারল্যান্ডের লোজান শহরে।
যদিও শেষ পর্যন্ত টরন্টোর দৃষ্টিনন্দন ওই ভবন হাতছাড়া করতে হয়নি কোম্পানিকে। পরে সেটাকে বাটার ‘পাওয়ার’ ব্র্যান্ডের সদরদপ্তর করা হয়।
বাংলাদেশে বাটা
ইউরোপে শ্রমিকের উচ্চ বেতনের কারণে ষাটের দশকে ব্যবসাকে নিম্ম-বেতনের দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার যে উদ্যোগ নেয় বাটা সু, সেই সুবাদে ১৯৬০ সালে বাটা আসে বাংলাদেশে, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।
সেই সময়ে বাংলার মানুষ সবেমাত্র ভাষার অধিকার আদায় করেছে। পশ্চিমের শাসকদের নিত্য বঞ্চনা, বৈষম্য পূর্ব ভূখণ্ডের মানুষের প্রতি। পণ্য উৎপাদন হয় পূর্বে, কারখানা হয় পশ্চিমে। আয় করে পূর্ব, সুবিধা ভোগ করে পশ্চিম। প্রতিদিন বড় হচ্ছে বঞ্চনার তালিকা, আর একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ।
ঢাকার ধামরাইয়ে বাটার কারখানা
পাকিস্তানিরা বাংলাভাষীদের গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাটা এ ভূখণ্ডের সম্ভাবনা দেখতে পায়। ১৯৬২ সালে তারা একটি কারখানা তৈরি করে পূর্ব পাকিস্তানে। সেই কারখানাটাই হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটার অধিকাংশ পণ্য তৈরি হয় বাংলাদেশে। এখানে কাজ করেন বাংলাদেশেরই মানুষ। এভাবে দেশের অর্থের বড় অংশ দেশেই থেকে যায়।
বাংলাদেশে প্রায় ৬৪ একর জায়গা নিয়ে বাটার ২টি কারখানা, একটা ধামরাই, আরেকটা টঙ্গীতে। এখানে কাজ করেন ৩ হাজার কর্মী। শুধু দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা নয়, বাটা বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরম আস্থার নাম।
উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড, বীরপ্রতীক
নাম উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড। হল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলীয় নাগরিক ওডারল্যান্ড বাংলাদেশে এসেছিলেন বাটার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ১৯৭০ সালে। ওডারল্যান্ডের আরেক পরিচয় হচ্ছে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা। আবার পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়নও চোখ এড়ায় না এই দক্ষ যোদ্ধার।
উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড, বীরপ্রতীক।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন শুরু হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞ, ওডারল্যান্ড তার পক্ষ নির্ধারণ করে ফেলেন। তার ভাষায়, “একাত্তরের মার্চে যখন পাকিস্তানি সৈন্য আর ট্যাংক ঢাকার রাস্তায় নেমে এল, আমি যেন আমার যৌবনের ইউরোপে ফেরত গেলাম।”
ওডারল্যান্ড পরে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তার নেতৃত্বে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করে, পাক হানাদারদের জন্য যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। এভাবেই ওডারল্যান্ডের হাত ধরে বাটা মিশে যায় বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিদেশি এই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাংলাদশ সরকার ওডারল্যান্ডকে ভূষিত করে বীর প্রতীক খেতাবে। ওডারল্যান্ডই একমাত্র বিদেশি, যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।